মনি হায়দার: তালা ভাঙব স্যার?
না ভাঙলে আলমারি খুলবে কী করে? তালা ভাঙার আদেশ দেন মিনহাজউদ্দিন।
সঙ্গে সঙ্গে হাতের হাতুড়ি দিয়ে তালার ওপর আক্রমণ চালায় পিয়ন রফিক। রুমটা দেড় শ বর্গফুটের চেয়ে একটু বড় হবে। মোটামুটি বড়ই বলা যায়। মিনহাজের সঙ্গে এক রুমে বসেন শামসুল হক। শামসুলের বাড়ি রংপুরের লালমনিরহাট। মিনহাজের বাড়ি বরিশালের পিরোজপুরে। দুই প্রান্তের দুজন মানুষ-একটি রুমে বসেন সাত বছর ধরে। অফিসটা সরকারি। দুজনেই সহকারী পরিচালক। একই রুমে পাশাপাশি বসেন। সবচেয়ে সুখের বিষয়, রুমটার দুই দিকে জানালা। বাইরের আলো-বাতাস আসে প্রচুর। মাথার ওপর ফ্যান তো আছেই।
শামসুল হকের চেয়ারের পেছনে বড় একটা কাঠের আলমারি। আলমারির পাশে একটা বড় ফাইল ক্যাবিনেট। আর টেবিলটাও সেক্রেটারিয়েট, বেশ বড়। টেবিলের ওপর পুরু কাচ। কাচের নিচে ফোম। ফোমটা অনেক দিনের, কেমন রঙে মরচে ধরেছে। খাওয়ার ব্যাপারে হকের কোনো বাছবিচার নেই। যখন যেখানে যা পাওয়া যায়, গোগ্রাসে গেলেন আনন্দের সঙ্গে। শামসুল হকের খাওয়া দেখে বিস্ময় মানেন মিনহাজউদ্দিন। হালকাপাতলা ধরনের একজন মানুষ-এত খায় কী করে? অফিস কলিগদের ছেলেমেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে হক সাহেব দর্শনীয় একজনে পরিণত হন। মাংসের ডিস আসছে, হক সাহেব সাবাড় করে দিচ্ছেন। গরুর মাংস দারুণ প্রিয়। এক থেকে দেড় কেজি সাবাড় করে দেন খুব সহজেই। চাপাচাপি করলে আরও আধা কেজি খেয়ে উঠতে পারেন, যদিও একটু কষ্ট হয়।
খাওয়ার পর বিশ্রাম বা গালগল্পের সময়ে জিজ্ঞেস করে মিনহাজউদ্দিন, পেট মোটামুটি আছে একখান আপনার। খুব যে বড় তা-ও না, কিন্তু এত খাবার রাখেন কোথায়?
হা হা হা হাসিতে ফেটে পড়েন হক সাহেব, আরে ভাই পেটখানা আমার ঠিক আছে, কিন্তু আমি কী করে বলব পেটে এত খাবার এঁটে যায় কেমন করে? আমার নিজের কাছেও রহস্য লাগে। তা ছাড়া পেট ভরে খাবার খাওয়ার মতো আনন্দ দুনিয়ায় আছে?
ঠিকই বলেছেন ভাই, খাওয়া অফুরন্ত আনন্দ। আরও আনন্দ সেই খাবার খেয়ে যদি হজম করা যায়।
হাসেন শামসুল হক, ঠিক বলেছেন মিনহাজ ভাই। আজ পর্যন্ত আমার কখনো পেট খারাপ করেনি। অথচ এক প্লেট ভাত আর গরুর কয়েক টুকরা মাংস খেয়ে অনেককে পেট খারাপ হতে দেখেছি। আমার পেট বলতে পারেন, হজমের জংশন। যা খাওয়াবেন আমাকে হজম হয়ে যাবে। এ জন্যই আমি বলি, লোহা খেয়েও হজম করে ফেলতে পারি।
পাশের অফিসের নারায়ণ বসাক প্রশ্ন করেন, জানি তো আপনি খানেওয়ালা একজন। পেট ভরে খেতে পারেন-একসঙ্গে দুই কেজি মাংস, আট-নয়টা ডিম, চার-পাঁচ প্লেট পোলাও এক বসাতে সাবাড় করে দিতে পারেন। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করছে, আপনার গোলগাল পেটে এত খাবার রাখেন কোথায়? আঁটে কীভাবে?
তাকায় মিনহাজের দিকে, মিনহাজ আমার কলিগ। আমরা অফিসে একটা রুমে বসি। ওরও প্রশ্ন আপনার মতো, আমার ছোটখাটো গোলগাল পেটের মধ্যে এত খাবার ধরে কীভাবে? ভাই রে, উত্তর আমার জানা নেই। আবার ধরুন, বাসায় বা হোটেলে অন্য কোনোখানে আমি কিন্তু স্বাভাবিক পরিমাণেই খাবার খাই। কিন্তু কোনো অনুষ্ঠানে খাবার খাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হলেই কোনো এক অলৌকিক ঘটনাচক্রে আমি প্রচুর খেয়ে উঠতে পারি। কীভাবে পারি, আমি জানি না।
তাই নাকি? প্রশ্ন করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবাক এক ভদ্রলোক।
স্যার ড্রয়ারের সব তালা ভাঙব? আলমারির তালা ভেঙে রফিক জিজ্ঞেস করে মিনহাজউদ্দিনকে।
হ্যাঁ, সব তালাই তো ভাঙার নিয়ম। অফিসের গুদাম থেকে ভাই কী কী এনেছিলেন, কী আছে এখন আলমারিতে, ফাইল ক্যাবিনেটে দেখে-একটা লিস্ট তৈরি করে মেলাতে হবে না?
জি স্যার, রফিক টেবিলের ড্রয়ারের তালার ওপর হাতুড়ি চালায়।
শামসুল হক মানুষ হিসেবে অবাক চরিত্রের। বাড়িতে বা বাসায় একেবারে পিতা-স্বামী। কিন্তু বাইরে এলে অন্য রকম হয়ে যান। অনেকটা প্লেবয় ধরনের। অফিসে একটা ডাকসাইটে ভাব নিয়ে চলার চেষ্টা করেন। সরকারের একটা সওদাগরি অফিস। একজন মহাপরিচালকের আন্ডারে পাঁচজন পরিচালক। অফিস থেকে প্রমোশন পেয়ে তিনজন পরিচালক আছেন। দুইজন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠিয়েছে পরিচালক হিসেবে। প্রশাসন থেকে আসা পরিচালকরা ভাব দেখায়-সচিবালয় আমাদের হাতের মুঠোয়। মন্ত্রণালয়ের ডিএস, জয়েন সেক্রেটারি-সচিবের সঙ্গে দারুণ খাতির। সুতরাং আমাদের সঙ্গে বুঝেশুনে কথা বলো!
অনেকে প্রশাসনের ক্যাডার হিসেবে তেল যে দেয় না, এমন নয়। কিন্তু শাসসুল হক একদম পাত্তা দেন না। প্রথমত, বয়সে বড় মিনহাজউদ্দিন আর শামসুল হক। দুজনেই প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হয়ে ঢুকেছেন। প্রমোশন পেয়ে পেয়ে অভিজ্ঞতায় পেকে পেকে পরিচালক হয়েছেন। মিনহাজের চাকরি আছে আরও তিন বছর। এক বছর পর রিটায়ারমেন্টে যাবেন শামসুল হক। দুজনার মধ্যে কলিগের বাইরেও ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
শামসুল হকের টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন মিনহাজউদ্দিন, প্রশাসনের পরিচালক রহমান খলিল, প্রশাসনের আরও দুজন কর্মকর্তা, সঙ্গে পিয়ন তিনজন। আরও আছেন শামসুল হকের স্ত্রী রাজিয়া হক। বড় ছেলে নির্মল হক ও একমাত্র মেয়ে অপরাজিতা হক। গুদামের প্রধান মতিউর রহমানও আছেন, সঙ্গে গুদামের দুইজন কর্মী। ওদের হাতে শামসুল হকের দেওয়া চাহিদাপত্রের পুরোনো কাগজ, সঙ্গে নতুন একটা খাতা।
শামসুল হক আর মিনহাজউদ্দিনের মধ্যে একটা পারিবারিক যোগাযোগও আছে। দুই ঈদে বা বিশেষ কোনো ছুটিছাটায় একে অপরের বাসায় আসা-যাওয়া করেন। সবই ঠিকঠাক, কিন্তু শামসুল হকের মধ্যে একটা খাই খাই বা সব আমার, আমার সব ভাব আছে। দুই মাস পরপর পরিচালক হিসেবে কেন্দ্রীয় গুদাম থেকে অনেক দ্রব্য আনান চাহিদাপত্র দিয়ে।
এত সব আনান কেন? নিজের টেবিল থেকে বলেন মিনহাজউদ্দিন। কী করবেন এসব দিয়ে? আর ব্যবহারও তো করতে পারবেন না।
আমি যে একটা ডিপার্টমেন্টের পরিচালক, আমার একটা ক্ষমতা আছে, আমার চাহিদা আছে-এটা জানান দিতে হবে না? চেয়ারে দোল খান আর বলেন শামসুল হক।
এসব আনালেই আপনার ক্ষমতা দেখানো হয়? অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন মিনহাজ।
আরে আপনি অবাক হচ্ছেন কেন? কেবল আমি একলা আনি? সবাই তো নেয়। কিন্তু আপনি তো চাহিদাপত্র দেন না তেমন-
বাড়তি জিনিসপত্র এনে কী করব? চায়ের কাপ, থালা, স্টাপলার, ফাইল, ফাইলকভার, প্লেট, গ্লাস, পেপারওয়েট-সবই তো আছে।
বাড়তি এনে আলমারিতে রেখে দেবেন। নিজের মনে বলেন শামসুল হক-এসব না আনলে ওরা, চোখ টেপেন শামসুল হক, নইলে ওরা বুঝবে আমরা কোনো কাজের না। সেই সুযোগ ওদের দেব কেন? ওরা মানে ডিজির প্রিয় পরিচালক প্রশাসন সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা দুই পরিচালক। এদের সঙ্গে বরকন্দাজ পাইক কয়েকজন।
চনমনে মানুষ শামসুল হকের অফিসের নানা ধরনের দ্রব্য এনে নিজের আলমারি, ফাইল ক্যাবিনেট আর টেবিলের ড্রয়ারে সাজিয়ে রাখার কী অর্থ হতে পারে? সত্যি কি এসব এনে একধরনের আমিত্ব জাহির করা যায়? বুঝতে পারেন না মিনহাজউদ্দিন। গত মাসের চাহিদা অনুসারে পিয়ন মোরশেদ একটা কার্টন ভরে গুদাম থেকে সব দ্রব্য নিয়ে আসে ঘাড়ে করে। রুমে ঢুকে দাঁড়ায় শামসুল হকের টেবিলের সামনে, স্যার এনেছি।
গুড। রাখো টেবিলের ওপর-প্যান্টের ওপরের বেল্টে ডান হাত ঘষতে ঘষতে দাঁড়ান শামসুল হক। প্যান্টের বেল্টের ওপর ডান হাত ঘষা প্রিয় অভ্যাস।
দাঁড়িয়ে কেন মোরশেদ? তাড়া দেন তিনি। জিনিসগুলো বের কর…
মোরশেদ তাড়া খেয়ে কার্টনের ভেতর থেকে তিনটা পেপারওয়েট, দুটি ছোট গ্লাস, একটি কাঁচি, ফ্লুরাইড, সাদা কাগজ এক প্যাকেটসহ আরও অনেক কিছু বের করে টেবিলের ওপর রাখে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন শামসুল হক টেবিলের ওপর স্তূপকৃত দ্রব্যাদির দিকে আয়েশি চোখে। পেপারওয়েটগুলো হাতে নিয়ে আপনমনে নাড়াচাড়া করতে করতে আবার তাড়া লাগান মোরশেদকে, আহা তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? জিনিসগুলো আলমারিতে তুলে রাখো।
রাখতেছি স্যার, মোরশেদ কাজে লেগে যায়। মিনহাজের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ান শামসুল হক, আপনার কী লাগবে?
মাথা নাড়ান মিনহাজ, আমার কিছুই লাগবে না হক ভাই।
আপনি কোনো কাজের না, ঠোঁট ওল্টান তিনি।
রাজিয়া হক বসেছেন মিনহাজউদ্দিনের টেবিলের সামনের চেয়ারে। রুমের মধ্যে আরও চারটে চেয়ার দখল করে পরিচালকসহ অন্যরা বসেছেন। বাকিরা দাঁড়িয়ে দেখছেন দৃশ্য। পিয়ন রফিকের সঙ্গে যোগ দিয়েছে গুদাম থেকে আসা দারোয়ান শিবশঙ্কর হালদার। দুজনে মিলে আলমারি, ক্যাবিনেট আর ড্রয়ারের তালা ভেঙে জিনিসপত্র বের করে টেবিলের ওপর জমা করছে। গুদাম থেকে আসা লোকজন হিসাব মেলাচ্ছে আর লিস্ট তৈরি করছে সাদা কাগজের ওপর।
১. আঠারোটা পেপারওয়েট, ২. আটটা প্লেট, ৩. নয়টা স্টাপলার, ৪. কাঁচি চারটে, ৫. হাত ধোয়া সাবান একুশটা, ৬. বাথরুমের সাবান এগারোটা, ৭. ডাস্টার আটত্রিশটা, ৮. গ্লাস এগারোটা, ৯. চায়ের কাপ চৌদ্দটা, ১০ বলপেন একশ আটটা…
শামসুল হক সাহেব এসব জমিয়েছেন কেন? চোখে কপালে ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করেন প্রশাসনের পরিচালক রহমান খলিল।
কেউ কোনো উত্তর দিচ্ছে না। কী উত্তর হতে পারে? শামসুল হকের স্ত্রী রাজিয়া হক গম্ভীর মুখে স্বামীর টেবিলের ওপর তাকিয়ে দেখছেন স্বামীর জমাকৃত সম্পত্তি। ভদ্রমহিলা এমনিতেই সুন্দরী। শরীরের মাংস আরও কয়েক কেজি কম হলে মধ্য বয়সের নায়িকা হিসেবে চালানো যেত। মুখে গাঢ় লাল লিপস্টিক। মেয়ে অপরাজিতা হক মায়ের একেবারে বিপরীত-পেনসিল শরীর। আর সালোয়ার-কামিজেই পূর্ণ। প্রসাধন নেই বললেই চলে, কিন্তু সুন্দর ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছে শরীরের বিন্দু বিন্দু কাঠামো থেকে।
স্যার এসব এনে জমা করতে খুব পছন্দ করতেন, মোরশেদ উত্তর দেয়। পুরোনো পিয়ন হিসেবে অনেকে ওকে চেনে। সহজ-সরল টাইপের ছেলে।
ভাবি? ক্যাডার থেকে আসা একজন পরিচালক তাকায় মিসেস হকের দিকে, ভাই খুব দিলদরিয়া মানুষ ছিলেন। প্রায়ই আমার রুমে যেতেন। আমিও আসতাম-রুমে এলেই চা না খাইয়ে উঠতে দিতেন না।
হ্যাঁ, আপনাদের বিষয়ে গল্প করতেন বাসায়…মিষ্টি গলায় উত্তর দেন রাজিয়া হক।
মিনহাজউদ্দিন অবাক চোখে তাকান ক্যাডার পরিচালকের দিকে, এই লোক কখনোই এই রুমে আসেনি। বরং শামসুল হককে কীভাবে অপদস্থ করা যায়, সেই ব্যাপারে প্রশাসনের পরিচালকের সঙ্গে রফাও করেছিল। অথচ বলছে কি না…
কিন্তু হক ভাইয়ের মৃত্যুটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার…পরিচালক প্রশাসন রহমান খলিল মিথ্যার ঢঙে সত্য বলে, আমি এখনো দেখতে পাই করিডরে আমাকে দেখে হাসতে হাসতে বলছেন-তোমার পেটটা আর হাফ ইঞ্চি কমাও, তাইলেই তুমি সিনেমায় নায়ক হতে পারবে-
রুমের মধ্যে হালকা হাসির ঝলক নামে।
আবার হিসাব চলছে-১১. তিন প্যাকেট সাদা কাগজ, ১২. ফাইলের ট্যাগ উনিশ বান্ডিল…
আমার বুঝে আসছে না, শামসুল হক সাহেব এত এত জিনিসপত্র এনে ভরে রেখেছিলেন কেন? ক্যাডার প্রশাসনের পরিচালক ওমর কায়সার বলেন, এটা কি ওনার বাতিক ছিল…
রাজিয়া হকের মুখের ওপর হালকা অসন্তুষ্টির ছায়া দেখা যায়। মেয়ে অপরাজিতা হক নির্বিকার। মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে চেয়ারের বাতার সঙ্গে ঠেস দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ছেলে নির্মল হকের মুখ কঠিন থেকে কঠিন হচ্ছে, নিজের চেয়ারে বসে লক্ষ করেন মিনহাজউদ্দিন।
ওমর কায়সার আবার বলেন, বিস্ময়কর ঘটনা একজন মানুষের সরকারি অফিসের ড্রয়ার থেকে এত সব জিনিস বের হচ্ছে! বলপেনই একশ আটটা আর ফাইলের ট্যাগ উনিশ বান্ডিল!
গুদামের প্রধান মতিউর রহমান বিরস মুখে হিসাব মেলাতে মেলাতে বলেন, প্রায় প্রতি মাসেই স্যার চাহিদাপত্র দিতেন। কিন্তু স্যারের চাহিদানুসারে সব জিনিস সব সময় গুদামে থাকত না, দিতে পারতাম না। স্যার খেপে যেতেন। বলতেন, কিসের অফিস চালাও-চাহিদামতো জিনিস দিতে পারো না? আমরা ভাবতাম…স্যার এগুলো নিয়ে কী করেন? আজকে বুঝতে পারলাম-
আপনার ধারণা ছিল আব্বু বাসায় নিয়ে যেতেন? প্রয়াত শামসুল হকের পুত্র নির্মল হক ঠাস করে প্রশ্ন রাখে। সঙ্গে সঙ্গে রুমের মধ্যে ভয়াবহ নিস্তব্ধতা নেমে আসে। মিনহাজউদ্দিন দারুণ উপভোগ করছেন সহকর্মী শামসুল হকের পুত্রের এই বাক্য ক্ষেপণাস্ত্র!
কী যে বলেন আপনি? মতিউর রহমান গলায় কৈ মাছের কাঁটা বাঁধার মতো করে পান খাওয়া ফোকলা দাঁতে হাসার চেষ্টা করেন-স্যারের, মানে আপনার আব্বুর বুকটা ছিল বিরাট। কোনো দিন আমাদের সঙ্গে রাগ করে একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি। স্যার মারাও গেলেন হঠাৎ করে। হক স্যারের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম।
আমিও, ঢুকে পড়েন রহমান খলিল-স্যারের মৃত্যুর সময়ে আমি অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে ছিলাম। শুনেছি চট্টগ্রামে বসেই, দুঃখে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, স্যারের জানাজায় থাকতে পারছিলাম না বলে। সত্যি, পরিচালক শামসুল হক স্যার ছিলেন অমায়িক মানুষ।
মিনহাজউদ্দিন টেবিলের ওপরে রাখা পুরোনা ফাইলের দিকে তাকিয়ে প্রবলভাবে মনে মনে হাসেন, মানুষ মারা যাওয়ার পর শত্রুরাও কি অসাধারণ বন্ধু হয়ে যায়! কী দরকার মিথ্যা উচ্চারণের? অকারণে প্রতারণাপূর্ণ ভণিতা রচনা করার? কখনো শামসুল হক কিংবা আমাকে পছন্দ করে না, খলিল। গত বছর মালদ্বীপে যাওয়ার একটা ট্যুর এসেছিল। শামসুল হক আর আমার নাম মহাপরিচালক প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু নানা ধরনের ঘুঁটি চালিয়ে মালদ্বীপ ভ্রমণ বন্ধ করতে চেয়েছিল, এই এরাই…। আর এখন? মানুষের মন আর মুখ যদি একই সঙ্গে দেখা যেত, কী চমৎকার বিষাক্ত দৃশ্য বিপরীতের মানুষেরা দেখতে পেয়ে বমি করত ঘণ্টার পর ঘণ্টা!
মিনহাজউদ্দিনের নাক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয়, হায় মানুষ!
ভাবি আসেন, ডাকেন মতিউর রহমান, দেখেন স্যারের ব্যক্তিগত কী কী জিনিস আছে এসব দ্রব্যের মধ্যে, যা তিনি বাসা থেকে এনেছেন! আমাদের লিস্ট শেষ।
সদ্য প্রয়াত শামসুল হকের টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে যায় রাজিয়া হক, অপরাজিতা হক, নির্মল হক এবং অফিসের সবাই। অনেক দেখেশুনে বিশাল টেবিলের ওপর স্তূপীকৃত নানা ধরনের বিচিত্র দ্রব্যের মধ্যে থেকে কিছুই নিতে পারেনি শামসুল হকের পরিবার, কেবল মাত্র ব্যাংকের তিনটে ব্যবহৃত চেক বই ছাড়া। আরও ছিল হাজার দেড়েক টাকা-একটা পাঁচ শ টাকার নোট, সাতটা এক শ টাকার নোট, বাকিগুলো পঞ্চাশ-বিশ-দশ টাকার নোট। টাকা আর ব্যাংকের বই তিনটে নিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় শামসুল হকের পরিবার। গুদামের লোকজন নিয়ে যায় শামসুল হকের রেখে যাওয়া থালাবাটি-গ্লাস-কাপ-পিরিচসহ যাবতীয় দ্রব্য। মোরশেদ এসে রুমটা পরিষ্কার করে চলে যায়।
পরের দিন সকালে গুদামের মতিউর রহমানকে ডেকে আনেন রুমে মিনহাজউদ্দিন। আগেই নিজে এবং পিয়ন মোরশেদকে নিয়ে আলমারিতে, ক্যাবিনেটে, টেবিলের ড্রয়ারে অফিসের যত ধরনের জিনিসপত্র ছিল, টেবিলের ওপর জমা করে একটা লিস্ট তৈরি করেন। মতিউর রহমান এলেন হাতে লিস্ট ধরিয়ে-টেবিলের ওপর থেকে সব নিয়ে যেতে বলেন।
অবাক মতিউর রহমান একবার হাতের লিস্ট দেখেন, আবার টেবিলের ওপর অফিসের জিনিসপত্র দেখেন, আবার দেখেন মিনহাজউদ্দিনকে। তিনি বুঝতে পারছেন না, ঘটনা কী?
স্যার, আপনার তো অল্প কয়েকটা জিনিস!
মতিউর, আমি বেঁচে থাকতেই অফিস থেকে নেওয়া সব ফিরিয়ে দিলাম। মৃত্যুর পর কোনো হিসাবের দরকার হবে না আপনাদের-হক ভাইয়ের সঙ্গে বিকেলে একসঙ্গে এই রুম থেকে বের হয়েছিলাম। রাত সাড়ে এগোরোটায় তিনি হাসপাতালে মারা যান। আপনি বুঝতে পারছেন আমাকে?
পাথর চোখে তাকিয়ে থাকেন মতিউর রহমান, স্যার আমিও আপনার মতো আজই হিসাব করে অফিসে সব বুঝিয়ে দেব। গলাটা কেমন আর্দ্র আর বিষণ্ন মতিউর রহমানের।
মিনহাজউদ্দিন চেয়ারে বসে শূন্য টেবিলের ওপর তাকিয়ে থাকেন, সব হিসাব কি বুঝিয়ে দেওয়া যায়!
সূএ:ঢাকাটাইমস ডটকম